নাইমুর রহমান, নিরাপদ মহাসড়ক নিশ্চতে সাংসদদের প্রস্তাবনা বিশ্লেষণে
সড়ক দূর্ঘটনার জন্য দেশজুড়ে বারবার আলোচিত হয় নাটোর। নেতিবাক ইস্যুতে জেলাকে ব্র্যান্ডিং করা হলে নাটোরকে বলা যেতে পারে ‘একসিডেন্টের জেলা’। ২০১৪ সালের ২০শে অক্টোবর নাটোরে ঘটে যাওয়া সড়ক দূর্ঘটনায় ৩৭ জন বাসযাত্রী নিহত হয়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মর্মান্তিক এ দূর্ঘটনায় মহা হৈ চৈ করে সড়ক নিরাপদ করতে উঠে পড়ে লাগে জেলা প্রশাসন। এরপর যা হবার, তাই হয়েছিলো। তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখলেও বাস্তবায়ন হয়নি ওই কমিটির একটি সুপারিশও। তৎকালীন জেলা প্রশাসক বদলির পর থেকে বর্তমান জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন পর্যন্ত ওই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের জন্য কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ নেননি। তবে চলতি বছরের ২৫ শে আগস্ট লালপুর উপজেলা কদিমচিলানের ক্লিকমোড়ে চ্যালেঞ্জার পরিবহনের একটি বাস যাত্রীবাহী অপর লেগুনাকে পিষে ১৫ যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হলে আলোচনায় আসে ২০১৪ সালের দূর্ঘটনার প্রতিবেদন। এ দূর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসন, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্তাদের টেবিলে টেবিলে শোভা পেতে দেখা যায় ৩৭ যাত্রী নিহতের তদন্ত প্রতিবেদন।
এমন পরিস্থিতে আবারও নাটোরের তিনটি মহাসড়ক নিরাপদ করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ১৫ যাত্রী নিহতের ১০ দিনের মাথায় নাটোরের ৪ সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ৭ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা-চেয়ারম্যানবৃন্দ, ৮ পৌরসভার মেয়র, বাস-মিনিবাস, ট্রাক-ট্যাঙ্কলরি সমিতির মালিক-শ্রমিক-কর্মচারী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিয়ে ‘নিরাপদ সড়ক প্রস্তাবনা’ নামের একটি সেমিনারের আয়োজন করে।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনের সভাপতিত্বে সেমিনারে অনান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নাটোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য, তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, নাটোর-৪ আসনের সাংসদ আব্দুল কুদ্দুস, নাটোর-২ আসনের সাংসদ শফিকুল ইসলাম শিমুল, নাটোর-১ আসনের সাংসদ আবুল কালাম, হাইওয়ে বগুড়ার অঞ্চলের পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ও নাটোরের পুলিশ সুপার বিপ্লব বিজয় তালুকদার। বক্তব্যে সকলেই একমত পোষণ করেন সড়ক নিরাপদ করতে।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, ‘মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনার পর অতি অল্প সময়ে আমরা টিমওয়ার্ক করেছি। ৭টি উপজেলা থেকেই আমরা সুপারিশ নিয়েছি। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে আমরা প্রস্তাবনা প্রত্যাশা করছি। সকলের সম্মিলত প্রচেষ্টা আশা করছি আমরা।’
নাটোরের পুলিশ সুপার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, ‘ ১৫ জনের মৃত্যুর পর আমরা সচেতন হয়েছি, এটা মানতে হবে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ মোতায়েন রাখলেও দূর্ঘটনা কমবে না যদি মানুষ না সচেতন হয়। যিনি আইন মানেন না, তাকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। শৃঙ্খলা আসছে না যাত্রীসাধারণের অসহিষ্ণু আচরণ ও মনোভাবের জন্য। রাস্তায় নামলে নিজের মতো নয়, আইন মতো চলতে হবে।’
হাইওয়ে বগুড়া অঞ্চলের পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মহাসড়কে যথাযথভাবে সাইন সিগনাল থাকলে দূর্ঘটনা কমে আসবে। এটি নিশ্চিতে নাটোরের জেলা প্রশাসক ও বিআরটিএ সহকারী পরিচালককে দায়িত্বশীল হতে হবে। যোগ্য চালকদের হাতেই গাড়ির চাবি তুলে দিতে হবে মালিকদের। মালিকদের নিশ্চিত করতে হবে যে, যোগ্য চালক ছাড়া তারা রাস্তায় গাড়ি নামাতে দেবেন না। প্রশিক্ষিত ও বৈধ লাইসেন্সধারী চালক গাড়ি না চালালে এবং এটি নিশ্চিতের পর প্রশাসনিক মনিটরিং না হলে কোন পদক্ষেপই সড়কে মৃত্যুর মিছিল রোধ করতে পারবে না।’
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট আবুল কালাম বলেন, ‘প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন প্রান্তের সড়ক দূর্ঘটনা গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। সড়ক দূর্ঘটনা আমরা আর চাইনা। মহাসড়কে আর মৃত্যু আমরা দেখতে চাই না। চালককে সচেতন হতে হবে। দোষ ফিটনেসবিহী গাড়ির তুলনায় লাইসেন্সবিহীন চালকেরই বেশী। গতি নিয়ন্ত্রণে সিগনালিং সিস্টেম চালু করার সুপারিশ করছি। এটি চালু হলে দেশের জন্যই হবে মডেল প্রাকটিস।’
নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বলেন, ‘ থ্রি-হুইলার চালিয়ে নাটোরের অর্ধলক্ষ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের পেটে লাথি মারা যাবে না। আইন মেনেই মহাসড়কের ফিডার রোড দিয়ে সেগুলো চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। মূল মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চালানো যাবে না। দূরপাল্লার গাড়িগুলোতে দুইজন করে চালক দিতে হবে। মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে মাটি বহনকারী যানবাহনগুলোর চলাচল বন্ধ করতে হবে। নতুন রাস্তা গর্ত সৃষ্টির মাধ্যমে নষ্ট করে দেয় মাটি বহনকারী যান, যেগুলো সড়কে দূর্ঘটনার অন্যতম কারন। সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে।’
নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস এমপি বলেন, ‘সড়ক দূর্ঘটনা আমাদের প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। আমরা তৎপর হয়েছি এখন যেভাবে, সর্বদাই সে তৎপরতা বজায় রাখতে হবে। সড়ক-মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জড়িত সকল পক্ষকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। মানুষের সহিষ্ণু আচরণ দরকার এক্ষেত্রে। নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন হলেই নিশ্চিত হবে নিরাপদ সড়ক।’
নাটোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য, তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার বক্তৃতায় বলেন, `প্রশাসনিক ও পেশাগত অদক্ষতা দূর্ঘটনা জন্য দায়ী। সড়ককে নিরাপদ করলে নাগরিকের জীবন নিরাপদ হবে। সড়ক, যোগাযোগ ও নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চিতে কাজ করছে সরকার। সড়ক নয়, মানুষকে নিরপদ করতে হবে। সড়কে মানুষের নিরাপত্তার জন্য গাড়ি ও চালকের ফিটনেস নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ডিস্ট্রিবিউটরদের রেজিস্ট্রেশন ছাড়া মোটরযান বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এটি নিশ্চিতে মালিক, শ্রমিক ও প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে। পুলিশকে সব কাজে দোষারোপ না করে সহযোগিতা করুন। শিক্ষকদের নিরাপদ সড়কের বার্তা শ্রেণিকক্ষে পৌছে দিতে হবে। নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নের জন্য সকল স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিতিভাবে একশন প্লান তৈরী করে কাজ করতে হবে। এছাড়া ফিলিং স্টেশনের মালিকদের তেল বিক্রির ক্ষেত্রে গাড়ির লাইসেন্স ও ফিটনেস চেকিং করা যেতে পারে। থ্রি-হুইলার চালকদের প্রতি কঠোর না হয়ে মানবিকভাবে তাদের রুটি রুজির বিষয়টি বিবেচনা করুন।’
(জাগোনাটোর টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত সংবাদ সম্পাদকের বিনা অনুমতিতে হুবহু বা অংশবিশেষ অন্য কোন গণমাধ্যমে কপি করে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হলো।)