নবীউর রহমান পিপলু: রাজা মহারাজা আর অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানীর নাটোরের সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং লোকজ ঐতিহ্যের ইতিহাস শত বছরের পুরানো। একসময় নাটোরে বারোমাসে নানা উৎসবের আয়োজন করা হতো। শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথি উপলক্ষে আয়োজন করা হতো জন্মাষ্টমীর মিছিল। শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে এখন আর জন্মাষ্টমীর মিছিল হয়না।
নাটোরের সাংবাৎসরিক নানা সমস্যা, সংকট, অন্যায়, অত্যাচার, ব্যাভিচার নিয়ে গল্প কথা, শাসক-শাসিতের আচার-আচরণের সত্য কাহিনীকে উপজীব্য করে ছড়া বেধে মিছিল করে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, যা আজকের পথ নাটকের মত। একাধিক দল শহর ঘুরে ঘুরে পথ নাটকের আদলে অভিনয় করে উপস্থাপন করতো এসব বিষয়গুলো।একেকটি দল দীর্ঘদিন মহড়া শেষে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে প্রর্দশন করতো তাদের অভিনয় পালা।
তৎকালীন সময়ে নাটোর শহরের প্রায় ২৫টি স্থানে অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা করা হতো। উদ্যোক্তাদের প্রতিটি দলকে ১২ টাকা করে চাঁদা দিতে হতো। সর্বোচ্চ ১০ জনকে নিয়ে একেকটি দল গঠন করা হতো। হিন্দু-মুসলমান সহ সকল ধর্ম ও পেশার মানুষ এইসব দলে যুক্ত হয়ে মিছিলে অংশ নিতেন। শহরের উপরবাজার, লালবাজার, নিচাবাজার, কাপুড়িয়াপট্টি, আলাইপুর প্রভৃতি মহল্লা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসাহী শিল্পি, ছড়াকার,বাদক প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে দল গঠন করা হতো। দলের পুরুষ সদস্যরাই নারী সেজে অভিনয় করতো। বিকাল থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত অবধি চলতো জন্মাষ্টমীর এই মিছিল। প্রতিটি দলে থাকতো একাধিক হ্যাজাক বাতি। প্রতিটি দলে সাথে হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোল,খোল-করতাল,বাঁশি ও একতারা সহ বিভিন্ন যন্ত্র থাকতো। মিছিলে সুর করে ছড়া বলার সাথে সাথে এসব বাদ্য যন্ত্র বাজানো হতো।
প্রত্যেক দল ছড়া গানের মাধ্যমে সে সময়ের ঘটনাবলী, শাসক-শাসিত, কৃপণ, দুঃশ্চরিত্র-লম্পট ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কের বিষয় তুলে ধরতো অভিনয়ের মাধ্যমে। যেমন-জমিদারী উচ্ছেদ আইন পাশ হওয়ার পর এবং ময়দা পেষা যান্ত্রিক কল আসার পর ছড়া বাধা হয়েছে এমনভাবে-
‘ময়দা পট্টির ময়দা ভাল,
আর ঘোরেনা জাঁতা,
শুকুল বাড়ির রাজার মাথায়
কেউ ধরেনা ছাতা।’
আবার মিউনিসিপ্যালিটি শহরে পানির কল বসালে এবং কামার সুধীর দাসের জীবন নিয়ে ছড়া বাধা হয়-
‘শংকরার চায়ের স্টল,
সামনে কল,
জ্বালায় হ্যাচাক বাতির আলো-
তার পাশে সুধীর কামারের
ঠকঠকাতেই দিন গেল।’
ছড়া বাধা হয় ভাল মুচি,দোকানী,কৃপণ ব্যক্তিসহ পোষাক পরিচ্ছদে বাবুগিরি করা যতীন নামের এক ডোমকে নিয়ে-
‘মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে নলিনী কামার,
ছোঁড়া জুতার মিস্ত্রি ভাল দশরথ চামার।’
‘ভগবানের সৃষ্টি-নাম যুধিষ্ঠি,
লোকটি বড় কষা (কৃপণ),
হালুয়া রুটির দোকান করেছে তারাপদ ঠসা।’
এছাড়া ছড়া বাধা হয়-
‘জ্বর নাই,জারি নাই জোগেশ সাহা কাবু,
মাঝে মাঝে দেখা যায় যতীন ডোম বাবু।’
এমন অসংখ্য ছড়া বেধে তা মিছিল সহকারে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরা হতো। অংশগ্রহণকারীরা নানা রংয়ের পোশাকে সজ্জিত হয়ে প্রতীকি ব্যঞ্জনায় মানুষকে শুধু আনন্দই দিতনা, কিছু চিন্তার খোরাক যুগিয়ে যেত। তবে ছড়া বাধার পর প্রদর্শন বা উপস্থাপনের জন্য থানা থেকে অনুমতি নিতে হয়েছে।
বিশিষ্ট আইনজীবি প্রসাদ তালুকদার বলেন, ‘জন্মাষ্টমীর মিছিল মানুষকে আনন্দ দিতো। কৌতুক অভিনয় করে মানুষদের হাসাতো। সব শ্রেণীর মানুষ ও বিশিষ্টজনদের দুর্নীতি,অনিয়মসহ নানা অপকর্মের ঘটনা ছড়ার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো। এই মিছিলের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন এলাকার নানা চাঞ্চল্যকর খবর অভিনয়ের মাধ্যমে জানানো হতো। একটি দলে আমার বাবাও থাকতেন।’
প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, শতবছরের পুরানো এই জন্মাষ্টমীর মিছিল নাটোরে ঠিক কখন থেকে শুরু হয় তা তারা জানাতে পারেনি। তবে শুরুর সময়কাল জানা না গেলেও ১৯৭৫ সালের পর শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথির জন্মাষ্টমীর মিছিল আর হয়নি। জন্মাষ্টমীর মিছিলে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। অনেকে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের অনেকেই নাটোরের মানুষের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে আছেন।
মিছিলে অংশ নেয়া প্রবীণদের কয়েকজন জহির উদ্দিন তালুকদার, আকবর আলী,নাজমুল হক,লাল্টু সরকার জানান,জন্মাষ্টমীর এই মিছিল ছিল সেসময়ের গণমাধ্যম। শহরের বিভিন্ন এলাকার সারা বছরের নানা খবর ছড়া বেধে এই মিছিলে অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো। এই মিছিলের ছড়া অনেকের বিবেককে নাড়া দিতো। যারা অপকর্ম করতো তারা লোক লজ্জার কারনে ভাল হয়ে চলতো।
জীবিত কয়েকজন উদ্যেক্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, কেবল উদ্যোগের অভাবে নাটোরে এখন আর জন্মাষ্টমীর মিছিল হয়না।