নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান,মাসব্যপী দলীয় কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে
নাটোরে শোকের আবহে আগস্টব্যাপী দলীয় কর্মসূচী পালন করেছে আওয়ামী লীগ। তবে বরাবরের মতোই এসব কর্মসূচী ছাপিয়ে স্পষ্ট হয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল- বিভাজন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাত্র চার মাস দূরে অথচ সাংগঠনিক ঐক্য এখনও দৃশ্যমান নয় দলটিতে। অনৈক্যের সুযোগে বিভক্ত নেতৃত্ব তাই এ মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও স্মরণ করেছে পৃথকভাবে। দলীয় কর্মসূচী থেমে থাকেনি শোক আর স্মরণের মধ্যেই, গড়িয়েছে হামলা থেকে মামলা পর্যন্ত। আগস্টের শেষ দিনগুলোতে হঠাৎ করেই চেনা রুপে ফিরে গেছে বিবাদমান গ্রুপগুলোর নিজস্ব সাংগঠনিক তৎপরতা। একই সংগঠনের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ, সাংসদদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিষোদগার-পাল্টা বিষোদগার, ব্যানার ফেস্টুন ছিড়ে নিজ দলীয় প্রতিপক্ষের কর্মসূচী পন্ডসহ বিভিন্ন ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংস রাজনীতির।
শোকদিবসের পোস্টারিংয়ে বাধা জেলার সিংড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সিংড়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলামের শোক দিবস উপলক্ষ্যে সাঁটানো পাঁচ শতাধিক পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনা ঘটছে আগস্ট মাসেই। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত পোস্টার ছেঁড়ায় শফিক সমর্থকসহ সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শফিক অভিযোগ করেন, এ কাজ করেছে তার দলেরই কিছু কর্মীরা। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইবেন এমন আক্রোশ থেকে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে দাবী করা হয় শিফকের পক্ষ থেকে। তখন প্রকাশ্যে পোস্টার ছিঁড়ে ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়ার সময় সুরুজ্জল নামের এক কর্মীকে হাতে নাতে আটক করে পুলিশে দেয়া হলেও তাকে পাগল দাবী করে আটকের অসস্মতি জানায় সিংড়া থানা পুলিশ।
হামলা থেকে মামলা নাটোরের বড়াইগ্রামে এবারে শোক দিবসের দিন হামলার ঘটনাও ঘটেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান ডাঃ সিদ্দিক পাটোয়ারীর অভিযোগ, বড়াইগ্রাম পৌরসভা চত্বরে আয়োজিত শোকসভায় জোনাইল ও চান্দাই ইউনিয়ন থেকে অংশ নিতে আসার সময় উপজেলার রোলভা এলাকায় তার সমর্থকদের উপর নাটোর-৪ আসনের সাংসদ আব্দুল কুদ্দুসের সমর্থকরা হামলা চালিয়ে ১৫ জন কর্মী-সমর্থককে আহত করে। এই হামলার ঘটনা গড়িয়েছে মামলা পর্যন্ত। এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের ১৭ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
যুবলীগের পৃথক সমাবেশ আগস্টের শেষদিকে এসে জেলায় যুবলীগের পৃথক দুইটি শোকসভা একটু করে উত্তাপ ছড়াচ্ছে জেলার রাজনীতিতে। ৩০শে আগস্ট শহরের মাদ্রাসামোড়ে সদর উপজেলা যুবলীগের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় শোকসভা যা শেষ পর্যন্ত সমাবেশে পরিণত হয়। ওই সমাবেশে জেলা আ’লীগ সাধারণ সম্পাদক ও নাটোর-২ আসনের সাংসদ শিমুলের পক্ষে ভোট চান যুবলীগ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বিপ্লব। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা আ’লীগের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ। পরদিন ৩১ সে আগস্ট পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শোকসভা করে জেলা যুবলীগ। তবে শোকসভা জনসভায় রুপান্তরিত হয় সদর আসনের সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের যোগদানকে কেন্দ্র করে। জেলা যুবলীগ সভাপতি বাসিরুর রহমান খান চৌধুরী এহিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে যোগ দেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাজেদুর রহমান খান, সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আহাদ আলী সরকার, নাটোর পৌর মেয়র ও নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি উমা চৌধুরী জলি, নাটোর সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রমজান, নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক অ্যাড. মালেক শেখ প্রমুখ। এদের মধ্যে শরিফুল ইসলাম রমজান, আহাদ আলী সরকার ও মালেক শেখ নাটোর-২ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তারা শোক দিবসের বক্তৃতার পাশাপাশি দলীয় বক্তব্যও দেন। দীর্ঘদিন পর এমন পাল্টাপাল্টি সমাবেশ বিরোধপূর্ণ রাজনীতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সাংসদের দূর্নীতির তালিকা প্রকাশের ঘোষণা আগস্টের শেষদিনে নাটোর-১ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বকুল লালপুরের বিভিন্ন জায়গায় পথসভা করেন। এদিন উপজেলার গোপালপুর বাজারের কড়ইতলায় উপজেলা আ’লীগ ও বকুল সমাবেশ করতে চাওয়ায় সংঘাতের আশঙ্কা তৈরী হয়। পরে বকুলকে গরুহাটায় সমাবেশের অনুমতি দিলে সেখানে পথসভায় তিনি ঘোষণা দেন, এ আসনের বর্তমান সাংসদ এডভোকেট আবুল কালামের বিভিন্ন নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির বিস্তারিত প্রকাশ করার।
বিবাদমান পক্ষগুলোর প্রতিক্রিয়া নির্বাচনের আগে এমন বিভাজন আর কোন্দলের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মনোনয়ন প্রত্যাশী ও বিবাদমান নেতারা।
সিংড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌর আ’লীগ সভাপতি শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, ‘ আমি সিংড়া থেকে নির্বাচনের উদ্যেশ্য দোয়া চেয়ে পোস্টার সাঁটিনি। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের শহীদ সদস্যদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে পোস্টারিং করেছিলাম। তবুও দলের ভেতরে একটি গোষ্ঠি আতঙ্কে থেকে সবাইকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ভেবে মূল স্রোত থেকে আলাদা করছে। শোক দিবসে আলাদা কোন কর্মসূচী পালন করিনি বরং দলীয় ব্যানারে সব কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছি।’
নাটোর-৪ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ও বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডাঃ সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘শোকদিবসে যথাযথ মর্যাদায় আমরা দলীয় কর্মসূচী পালন করেছি কারো বিরুদ্ধে বিষোদগার ছাড়াই। বর্তমান সাংসদ আব্দুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিইনি আমরা। বরং উপজেলায় দলের কোন কর্মসূচীতে আমি ও আমার সমর্থকরা যোগ দিলে তিনি বিব্রত হন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে আলাদাভাবে স্মরণ করেছি কিন্ত এমন কোন বক্তব্য দিইনি যে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে আমরা এমন কোন কাজ করবো না যে দলের ক্ষতি হয়। আমরা আবারো এ আসনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চাই।
শহরে যুবলীগের পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ব্যাপারে জেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বিপ্লব বলেন, ‘৩০ তারিখে সদর উপজেলা কমিটির আয়োজনে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্ত পরদিন জেলা যুবলীগের ব্যানারে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা শোকসভার নামে যে সমাবেশ করেছেন, সেটি কোন কেন্দ্রিয় কর্মসূচী ছিলো না। ওই সমাবেশের আয়োজকরা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে সমাবেশটি করেছেন যুবলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে।
যুবলীগ সাধারণ সম্পাদকের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে সংগঠনের সভাপতি বাসিরুর রহমান খান চৌধুরী এহিয়া বলেন, ‘যুবলীগ সভাপতি হিসেবে আমি শোকসভার আয়োজন করেছি। সভায় যোগ দিতে মাইকিংও করা হয়েছিল। তাই কেউ আসলে বাধা দেয়ার সুযোগ নেই। বরং সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বিপ্লব আসেননি। আবার সদর উপজেলা কমিটির শোকসভায় যোগ দিতেও আমন্ত্রণ জানাননি। অথচ অতীতে যুবলীগ আমার নেতৃত্বে কঠিন সময় পার করেছে। আজ যারা বড় বড় কথা বলেন, সেদিন তাদের কেউই ছিলো না। আমি কেন্দ্রিয় নির্দেশনা মেনেই দলের বৃহত্তর স্বার্থে সংগঠনকে সংগঠিত করছি।’
নাটোর-১ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী শহিদুল ইসলাম বকুল বলেন, ‘দলের দূর্নীতিবাজ নেতাদের স্বরুপ উন্মোচন করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই বিভাজনের রাজনীতি করা নয়। এখন সমাবেশ করলাম অথচ কিছু বললাম না বা প্রতিবাদ করলাম না, তা হয় না। আমরা প্রতিবাদ করেছি দুর্নীতির কিন্ত সরকারের পক্ষে জনমত বাধাগ্রস্ত হয়, এমন কিছু বলিনি। আমরা চাই আবারো এ আসনটিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করুক।’
দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বক্তব্য
সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিনহাজ উদ্দিন বলেন,’শোকের আবহে যথাযথ মর্যাদায় সকলকে সাথে নিয়েই শোক দিবস পালিত হয়েছে সিংড়ায়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো কোন নেতার পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনা দলীয় ফোরামে জানানো হয়নি। এখনো জানানো হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রী পলকের নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ।’
বড়াইগ্রাম উপজেলা আ’লীগ সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘মনোনয়ন প্রত্যাশী কোন কোন ব্যক্তি দলে বিভক্তি ছড়াচ্ছেন, মানুষের কাছে দলের ব্যাপারে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব নেতাদের বিরুদ্ধে তৃণমূল কর্মীদের সতর্ক হতে হবে।’
বাগাতিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাগঠনিক সম্পাদক সুকুমার মুখাজ্জী বলেন, ‘এখন সময় দলকে নির্বাচনের জন্য সংগঠিত করা। অথচ মনোনয়ন চাওয়ার নামে সাংসদের বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছেন অনেকে। সাংসদকেই প্রতিপক্ষ মনে করছেন। এর মানে সরাসরি দলীয় নির্দেশনা অমান্য করা। এদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।’
জেলায় দলের সহ-সভাপতি এডভেকেট সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বড় দল হিসেবে যে কোন সময়ের চেয়ে আ’লীগে এবার মনোনয়ন চেয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিযোগিতা বেশি। প্রতিযোগিতা দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চার পরিচায়ক। উদ্বেগের বিষয়, সুস্থ ধারার প্রতিযোগিতার পাশাপাশি বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত কেউ কেউ। নিজেকে জাহির করার প্রয়োজনে অনেকেই বক্তব্য-আচরণে মানুষের মনে দল সম্পর্কে খারাপ ধারণা পুশ করছেন। এতে সরকারের অর্জনগুলো মানুষ ভালোভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ফলে, ভালো কাজ করেও দলের পক্ষে জনমত বাড়ছে না।’
এসব বিষয়ে দলের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জাগোনাটোর টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘জাতির জনককে পৃথকভাবে স্মরণ করা যেতেই পারে কিন্ত তা যেন এমনভাবে না হয় বিভেদ প্রকাশ পেয়ে মানুষের মনে দল সম্পর্কে নেতিবাচক মনেভাব সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ প্রায় দশ বছর ধরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় বেড়েছে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ও সক্ষমতা। তবে নির্বাচন ইস্যুতে সবকিছু পর্যবেক্ষণে রাখে হচ্ছে।’
(জাগোনাটোর টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত সংবাদ সম্পাদকের বিনা অনুমতিতে হুবহু বা অংশবিশেষ অন্য কোন গণমাধ্যমে কপি করে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেত অনুরোধ করা হলো।)