আদিবের কল্পনার কতটা জুড়ে অরন্তি, তা আদিবই জানে। যেখানে ভালোবাসা সত্যিকারের, সেখানে অজানা শঙ্কার ভয় সত্যিই থাকে।
একটু আগে আদিব যে স্বপ্ন দেখেছে, তা সত্যি হবার নয়। যা স্বপ্নে দেখা যায়, তা তো স্বপ্নই। স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না। স্বপ্ন আর বাস্তবতার ফারাকটুকু এখন বোঝে আদিব। স্বপ্নে যা সোনালী, বাস্তবে তা ধূসর মাত্র। তবে একটা হিসেব সে কিছুতেই মেলাতে পারে না। স্বপ্নের অরন্তি এমন কেন? স্বপ্নে অরন্তিকে মনের কথাগুলো সব বলা যায়। আবার কি বলা হবে, অরন্তি নিজেও হঠাৎ হঠাৎ বুঝে নেয়।
এই ঘন্টাখানেক আগেই স্বপ্নের মধ্যে বাদাম কিনে পকেটে হাত দিয়ে মুখ যে লজ্জায় লাল হলো, তা বুঝতে পেরেই অরন্তি ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে চকচকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে দিলো। অথচ স্কুলজীবনের শেষদিকে অরন্তির অজান্তে ওর ব্যাগে এক ঠোঙ্গা ভাজা ছোলা ঢুকিয়ে দিয়ে ধরা পড়তে হয়েছিল। সে কি ধরা রে বাবা! খাতার পাতা ছিড়ে বানানো ঠোঙ্গাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়ায় ধরে ফেলেছিল বুদ্ধিমতি অরন্তি। এরপর থেকে বরাবরের মতই সাবধান আদিব।
এসব ভাবতে ভাবতে বেজে উঠলো সেলফোনটি। আদিবের বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠলো! অরন্তি ফোন করেছে। যে অরন্তি দেখা হলে এড়িয়ে যায়, সে ফোন কেন করতে পারে ভাবতে ভাবতেই সেলফোন বাজা থেমে গেল। এবার যেন সম্বিৎ ফিরে এল আদিবের। নিজের উপর খুব রাগ হল। এতোসব ভাবনা তো পরেও ভাবা যেত! কেন সে ফোনটা রিসিভ করলো না! অরন্তি কি ভাবলো! এবার আদিব ফোন দিতে শুরু করলো। একবার, দু’বার করে অনেকবারই হল, কিন্ত ওপারের সাড়া নেই। এক অদ্ভুদ কল্পনায় মগ্ন হল আদিব!
“এই যে ঘুমবাবু! ক্যামনে ঘুমাও এতো? একবার দেখসো, ফোন দিসিলাম? দেখার সময় পাওনাই বুঝি? তা পাবা কেনো, আমি তো পর”- অনুযোগের সুরে অরন্তি একটানা বলে গেল।
“ভাবিনাই তুমি নক করবা আমায়। একটু অবাকই হইসিলাম তোমার ফোনে। তুমি তো কখনও ডাকো নি। চাইলে এখনও আপন হবার সুযোগ আছে তো……!”
কল্পনায় ভাবের এমন বিনিময় চলতে চলতেই ছন্দপতন। স্ক্রীণে দেখা গেল অপুর ছবি। ধরার আগে আদিব ঠিক করলো কষে একটা গালি দেবে অপুকে। কিন্ত শেষ অবধি পারলো না।
“অরন্তি তোকে খুঁজছিলো। সম্ভবত কথা বলার চেষ্টা করছিলো। তোকে দরকার ওর, মনে হল। পারলে দেখা কর”।
”কেন রে দোস্ত? আমায় ফোন দিসিলো, ধরতে পারিনি। পরে আমি দিলে, ও ধরেনি। ব্যাপারটা কি?”
“শোন, মেজাজ খুব খারাপ আছে সকাল থেকে। বাড়ি থেকে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিসে ঘুম ভাঙ্গিয়ে। এখন হাতে ব্যাগভর্তি বাজার। আর তুই এখন ঘটনা জানতে চাস হারামি? রাখ!
এবার আদিবের চিন্তা জেঁকে বসলো। কয়েকমুহূর্ত কি যেন ভেবে উঠে পড়লো বিছানা থেকে। ঝটপট তৈরী হল বের হবার জন্য।
আজ ওর কোথাও একটা যাওয়া ছিলো। তার জন্য নীল পাঞ্জাবীটা ইস্ত্রী করে আনা ছিলো। কি ভেবে ওটা পরেই রওনা দিলো আদিব।
ভালোলাগা আর ভয় এই দু’য়ের ছাপ আদিবের চোখেমুখে। আদিব আবেগপ্রবণ। মনে কষ্ট পেলে মুষড়ে পরে। অজানা শঙ্কায় শংকিত সে। অরন্তি তার স্কুল জীবনের সহপাঠী। আনমনা অরন্তিকে কখনো আদিব বলেনি ভালোলাগার কথা। যদি সব শুনে অরন্তি না বলে দেয়? কথা বন্ধ করে দেয় আদিবের সাথে?
আদিব রিক্সায় যেতে যেতে ভাবছিলো এসব। তখন ট্রাফিক মোড় পার হচ্ছে সে। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আরেকটি রিক্সাযোগে অরন্তিকে আসতে দেখা গেল।
আজ অরন্তিকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। নীল সালোয়ারে এতটাই মোহনীয় লাগছিল ওকে যে ক্ষাণিকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আদিব। যখন মনে হল অরন্তি আজ তাকে ফোন করেছিল তখনই ঘোরটা কেটে গেল। সাথে সাথে ডাক দিলো অরন্তিকে।
আদিবকে দেখেই থামল অরন্তি। ওর রিক্সাটা ছেড়ে উঠে এল আদিবের রিক্সায়।
”তুই কি আজ বিজি? অরন্তি জানতে চাইলো।
”আরে না! বিজি থাকবো কেন? তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম আমি…”
অরন্তির অস্ফুটস্বর, ”ওহ”!
অরন্তি কিছুক্ষণ আদিবের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। অরন্তির শঙ্কিত মুখটা দেখে অাদিবও থমকে গেল। এবার তার মনে নানারকম কৌতুহল জেগে উঠল। যে অরন্তি তাকে সেভাবে কখনও পাত্তাই দিতো না, সে কোন আশা নিয়ে আজ তার দুয়ারে? কী কথা থাকতে পারে অরন্তির? কেনই বা প্রয়োজন? বুঝতে না দিয়ে মুখে হাসি নিয়ে কাঁপা গলায় অরন্তিকে জিজ্ঞাসা করলো,”কি হয়েছে তোমার?”
”আদিব, তোকে কিছু বলার আছে আমার। শুনবি? সময় হবে তোর?”
বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো আদিবের।
কাঁপা গলায় সে উত্তর দিলো-”শুনবো”!
“আদিব, মনে আছে স্কুল একবার আমার পিছু নিয়েছিলি? প্রায়ই নিতিস, তবে ওই যে বিশ্বরোড পার হয়ে রিক্সায় যাচ্ছিলাম মা আর আমি। তুই কারো সাইকেলের পিছনে ছিলি। রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা মাইক্রোবাসের নীচে একটু হলেই চাপা পড়তিস। তোর মনে আছে, আমার পিছু পিছু বাড়ি পর্যন্ত আসতি তুই, কেউ আমায় বিরক্ত করে কিনা দেখবি বলে? তুই ঝড়ের মধ্যেও স্কুলে আসতি আমি আসি কি-না দেখবি বলে। কলেজে আমার জন্য তুই তানভীরদের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করলি। আমার জন্য শখের ঘড়িটাও তুই বেঁচে দিয়েছিলি। আমি কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলাম বলে রিসেপশনে ফোন করে পাগল করে দিচ্ছিলি নার্সদের?”
আমার জন্য শহর ছাড়লি না তুই। তুই তো নিজেকেই এতো ভালোবাসিসনা, যতটা আমাকে ভালোবাসিস। তবে কেন এতদিন বলিসনি। কিভাবে পারিস সব চেপে রেখে আমার জন্য অপেক্ষা করতে?”
বলতে বললে অরন্তির গলাটা ধরে এলো। চোখ ভিজে গেছে ওর। আদিব মাথা নীচু করে আছে। চোখ তুলে অরন্তির দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছে না ওর।
এবার অরন্তির চোখেও জল।
আদিবের উত্তর, ” আমি তোমায় ভালোবেসেছি সত্যিই। তবে হারানোর ভয়টা বেশি ছিল। তাই কখনও বুঝতে দিইনি। তোমায় ভালোবাসি, এটা না বলে থাকার কষ্ট সইতে পারবো, কিন্ত ভালেবাসার কথা জেনে যদি আমায় ফিরিয়ে দাও, সেটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি তোমাকে হারাতে চাইনি। আজও চাইনা। ভালোবাসবে আমায়?”
“আট বছর ধরে আড়াল থেকে যে ভালোবাসতে পারে, তাকে ভালোবাসা যায়। তার ভালোবাসাটা সত্যি। আমি এই ভালোবাসা হারাতে চাই না। এখন থেকে আর স্বপ্নে আসবি না বলে রাখলাম। তুই আর আমায় স্বপ্নে দেখিস না, ঠিক আছে? “
গল্পঃ নাইমুর রহমান