নবীউর রহমান পিপলুঃ বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবদ্দশায় নাটোরের চলনবিল সহ উত্তরাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেছিলেন। ৮টি প্রদেশসহ নাটোরে মিনি পার্লামেন্ট ভবন করারও সদিচ্ছা ছিল তার। কিন্তু তাকে হত্যার পর তার সেই সদিচ্ছার অনেক কিছুই পুরন হয়নি । শোকের মাস আগষ্টের স্মৃতি চারন করতে গিয়ে এমনই তথ্য জানান সেসময়ের বৃহত্তর রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি,৬ দফা আন্দোলনের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক, ১১ দফা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক এবং বর্তমানের নাটোর-(৪) আসনের সংসদ সদস্য ও নাটোর জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস ও জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সাবেক সাংসদ মুজিবুর রহমান সেন্টু সহ ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন স্থানীয় নেতা কর্মী। সে সময়ের স্নেহভাজনদের অনেকেই তার সদিচ্ছার বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজনদের স্থানীয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস,কামরুল ইসলাম,অনাদি বসাক,নাজমুল হক লালা,আব্দুল মজিদ খান ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে জাতীয় পার্টির নেতা মুজিবুর রহমান সেন্টুর দেওয়া তথ্যে জানাযায়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবদ্দশায় যখনই সময় পেয়েছেন নাটোরে এসেছেন। গ্রামগঞ্জে হেঁটে বেড়িয়েছেন। নৌকায় চড়ে চলনবিল ঘুরেছেন। চলনবিলের দুর্গম গ্রাম সিংড়ার তাজপুর গ্রামে সে সময়ের বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন সহচর মরহুম সাংসদ আশরাফুল ইসলামের বাড়িতে গিয়েছেন। গোসল করেছেন,মানুষের সাথে কথা বলেছেন এবং চলনবিলসহ বাংলাদেশের উন্নয়নের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলেছেন। নাটোরে আসার পর তিনি সাধারনভাবে থেকেছেন। সাধারনমানের একটি আবাসিক হোটেলে বসে সাংগঠনিক মিটিং করেছেন। নাটোর বোডিং নামে একটি আবাসিক হোটেলে উঠতেন। তবে কখনই রাত্রি যাপন করেননি। সাংগঠনিক কর্মকান্ড শেষে ফিরে গেছেন। স্বাধীনতার পর স্বল্প সময়ে তিনি নাটোরে যে ক’বার এসেছেন উঠেছেন উত্তরা গণভবনে । বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় নাটোরকে নিয়ে আপন করে ভেবেছেন । নাটোরকে একটি প্রদেশের রাজধানী ও মিনি পার্লামেন্ট করার পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ৭৫ এর ১৫ আগস্টে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলে তার সেই সদিচ্ছা পুরনের সুযোগ হয়নি।
সাংসদ অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস জানান,স্বাধীনতার পরও ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া রাজা মহারাজা ও অর্ধ বঙ্গেশ্বরী রানী ভবানীর স্মৃতি বিজরিত নাটোরকে নিয়ে ভেবেছেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসখ্যাত নাটোরে কেবিনেটের সভা করেছেন তিনি। উত্তরাঞ্চলের কেন্দ্রস্থল হিসেবে উদারতার সাথে নাটোরকে বেছে নিয়ে দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষনা করেন। এই নাটোরে বসেই দেশে ৮ টা প্রদেশ করাসহ নাটোরে একটি মিনি পার্লামেন্ট করার সদিচ্ছার কথা বলেছিলেন। নাটোরকে একটি প্রদেশের রাজধানী করাসহ পার্লামেন্ট ভবন করার জন্য সে সময়ের ডিসি আব্দুর রউফ সাহেবের কাছে জায়গা চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু । তিনি ডিসিকে বলেছিলেন একটি জায়গা দাও নাটোরে মিনি পার্লামেন্ট করি। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু নাটোরের ঐতিহ্যকে এমনভাবে উপলদ্ধি করেছিলেন যে, দেশভাগ নিয়ে যখন কোন অংশ পাস্তিানের এবং কোন অংশ ভারতের পক্ষে সে নিয়ে ১৯৪৬ সালে ভারতের বালুরঘাটে উপ নির্বাচন অণুষ্ঠানের সময় যুব সমাজের পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচন পরিচালনার করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন হোসেন শহীদ সহরোওর্য়াদি। নাটোরকে বঙ্গবন্ধু এতই ভালবাসতেন যে, সেই সময় নাটোর হয়ে বালুরঘাট গিয়েছিলেন। ওই সময় চলনবিলের তাজপুর গ্রামে গিয়েছিলেন। পরে বগুড়ার কিছু স্বোচ্ছাসেবক সঙ্গে নিয়ে দিনাজপুরের হিলি হয়ে বালুরঘাট গিয়েছিলেন। যখনই তিনি রাজনীতির মাঠে থেকেছেন তখনই গ্রামে গ্রামে গিয়েছেন। কথা বলেছেন সাধারন মানুষের সাথে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা প্রচার করেছেন। বিশাল চলনবিলের মধ্যস্থল নাটোর ভাল যোগাযোগের স্থান হওয়ায় বঙ্গবন্ধু বিষয়টি অনুভব করে নাটোরকে বেছে নিয়েছিলেন চলনবিলের মধ্যবর্তী স্থান হিসেবে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী পাকিস্তান কারাগার থেকে দেশে আসার পর ৯ মে রাজশাহীতে জনসভায় যাওয়ার আগে নাটোরে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নাটোরকে উত্তরবঙ্গের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বেছে নিয়ে দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষনা করেছিলেন। তিনি সাধারন মানুষদের সাথে আন্তরিক ও গভীরভাবে মিশতেন। ১৯৭২ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু নাটোরের উত্তরা গণভবনে অবস্থানের সময় ১৯৪৬ সালে তাজপুর গ্রামের পরিচিত হওয়া নুরুদ্দিন নামে এক ব্যক্তি তার জমি থেকে উৎপাদিত লাউসহ শাক সবজি মাথায় নিয়ে গণভবনে দেখা করতে আসলে তাকে প্রথমে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবে তার নাম শুনেই বঙ্গবন্ধু তাকে সহজেই চিনে ফেলেন এবং ভিতরে নিয়ে আসতে বলেন আমাকে। নুরুদ্দিনের নিয়ে আসা শাক সবজির ডালা বঙ্গবন্ধুর এপিএস হানিফ ও মুন্সিগঞ্জের আওয়ামীলীগ সভাপতি মহিউদ্দিন ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমার ভাবির জন্য ওগুলো নিয়ে নেও । ৪৬ সালে পরিচিত হওয়া মানুষটিকে বঙ্গবন্ধু সহজেই চিনতে পারায় উপস্থিত সকলেই বিস্মিত হই। জাতির জনক এমন সহজ সরল মানুষ হতে পারে তা ভাবতেই শুধু নয় গর্বিত বোধ হয়। বঙ্গবন্ধু নাটোরে এসে সাধারনভাবে থাকতেন । নাটোর বোডিং নামে মনোয়ার হোসেন মুন্নুর আবাসিক হোটেলে উঠতেন। রাজশাহীর প্রয়াত নেতা কামরুজ্জামান ভাইসহ অনেকেই সেখানে এসে সাংগঠনিক সভায় যোগদান করতেন। নাটোরের প্রতি মমত্মবোধের কারনে বঙ্গবন্ধু বারবার নাটোরে এসেছেন। তার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশকে ৮ টি প্রদেশে বিভক্ত করার। যার একটির রাজধানী নাটোরে করবেন । একই সাথে প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নাটোরে একটি মিনি পার্লামেন্ট করারও সদিচ্ছা ছিল তাঁর। তিনি আরও জানান, বঙ্গবন্ধুকে অধিকাংশ সময় কারাগারে থাকতে হয়েছে। যখন বাহিরে থেকেছেন তখনই গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন,সাধারন মানুষদের কাছে গেছে এবং তাদের কথা শুনেছেন। ১৯৬৪ সালে তিনি একবার নাটোরে আসেন । তখন সিংড়া এলাকায় টর্নেডোয় ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে রিলিফ বন্টনের জন্য সিংড়ায় গিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারের দালাল মোনেম খানের ঘোষনা ছিল যতক্ষন সে ক্ষমতায় থাকবে ততক্ষন বঙ্গবন্ধুকে জেলখানায় থাকতে হবে। সেই ঘোষনার পর বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরন করা হয়। এ ইতিহাস অনেকেরই জানা। ীধ্যাপক কুদ্দুস জোর দিয়ে বলেন,বঙ্গবন্ধু নাটোরকে বেশী প্রাধান্য দিতেন বলেই দেশ স্বাধীনের পর ৭২ এর র্ফেরুয়ারী মাসের দিকে দলের আওয়ামীলীগের উত্তরাঞ্চল শাখার বর্ধিত সভা নাটোরে করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার নির্দেশে ওই সভা বগুড়ার পরিবর্তে নাটোর গণভবনে অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ সময়ে এই অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিরা সরকারের অংশ হতে না পারায় তার সদিচ্ছার বাস্তবায়ন করা যায়নি। অবশ্য সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে তাই উদ্যোগ নিলে বঙ্গবন্ধুর সদিচ্ছার বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
সিংড়া এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম আশরাফুল ইসলামের চলনবিলের তাজপুর গ্রামের বাড়ির প্রবীণ ভৃত্য জেহের আলী জানান, বঙ্গবন্ধু একবার তাজপুর গ্রামে এসেছিলেন। সেবার বাড়ির সামনের পুকুরে গোসল করেছেন। গ্রামের মানুষের সাথে একান্তভাবে কথা বলেছেন। অনেক কিছু করার কথা বলেছিলেন। দুপুরে পবদা ও কই মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছেন। গ্রামে বানানো দই -মিষ্টি কেয়েছেন। তিনি কই মাছ খুব পছন্দ করেন। কিছু সময় কাটানোর পর সিংড়ায় চলে যান। নৌকা করে চলনবিল ঘুরে ঘুরে দেখেছেন।
সেসময়ের ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমানে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান সেন্টু বলেন, বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের বেশী আদর করতেন। আমাদের নামে চিনতেন। বঙ্গবন্ধু নাটোরে এসে সাধারনভাবে থেকেছেন। যতবার এসেছেন নাটোর বোডিং নামে একটি সাধারন মানের আবাসিক হোটেলে উঠেছেন। তখন নাটোরে কোন ভাল আবাসিক হোটেল ছিলনা। ডাক বাংলো পাওয়া যেতনা বিরোধী দল হওয়ার কারনে। একবার সিংড়ায় রিলিফ বন্টনের জন্য তিনি আমাদের সাথে নিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু নাটোরের মাটি ও মানুষকে অত্যন্ত ভালবাসতেন বলে তার বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা হলে নাটোরের মানুষ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন মামলা পরিচালনার জন্য । স্বাধীনতার পরও বঙ্গবন্ধু নাটোরে এসেছেন কয়েকবার। নাটোর সহ উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের সদিচ্ছার কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নাটোরের উন্নয়নে তার সদিচ্ছার বাস্তবায়ন হত বলে মনে করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সদিচ্ছার বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহব্বান জানান তিনি।
লেখকঃ
বীর মুক্তিযোদ্ধা
প্রকাশক, জাগোনাটোর২৪ ডটকম এবং
নাটোর প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল এবং একুশে টেলিভিশন