শোকে ‌স্মরণ নেই, উৎসবের ব্যঞ্জনা!

শোক দিবস আজকাল স্মরণের নয়, রীতিমতো উৎসবের। অথচ ক্ষমতাধরদের বিশ্বাসঘাতকতার বলি হয়েছিলেন বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে কারা ‘চোর’, বঙ্গবন্ধু কিন্ত তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। সেই চোরদের বঙ্গবন্ধু মানুষের প্রভু নয়, সেবক হতে অনুরোধ করেছিলেন। সেই চোররা আজ এলিট শ্রেণিতে বসবাস করে। এখন ক্ষমতায় প্রতাপাদিত্য এইসব চোরেরা। এই চোরেরা এখন বঙ্গবন্ধুর বন্দনায় অগ্রকণ্ঠ। এই চোরদের সিন্ডিকেট এতোটাই শক্তিশালী যে তারা বঙ্গবন্ধুর দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রের বড় বড় পদে আসীন। এখন এমন কেউ নেই যে কি না বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে না। আজ যদি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা বেঁচে থাকতেন, তবে কারান্তরীণ অবস্থাতেই ‘নব্য বঙ্গবন্ধু ভক্তদের’ আচরণে লজ্জাতেই মরে যেতেন বলে আমার বিশ্বাস। কষ্ট লাগে রাষ্ট্রেরও বলিহারী আচরণ দেখে। কেউ যদি নিজের স্বার্থে জাতির জনকের নাম ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, সে যতবড়ই বাজে হোক রাষ্ট্র যেন তার প্রতি অন্ধ হয়ে যায়! এটি ঘোর অশনি সংকেত।

কই, কয়েক বছর আগেও তো এতো বঙ্গবন্ধু প্রেমিক ছিলো না! কি এমন হলো, যে সবারই জানান দিতে হবে বঙ্গবন্ধুপ্রীতির কথা? আজ যারা বঙ্গবন্ধুর নামে জিকির করছে, রাষ্ট্রক্ষমতার প্রেক্ষাপট বদলে গেলে তাদেন দশ জনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, গ্যারান্টি।

নিজ যৌবন ক্ষয় করেছেন বঙ্গবন্ধু পরাধীন দেশে দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙতে। সংগ্রাম মুখর জীবনে মৃত্যুও ফেরার হয়েছে তার থেকে। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা এলো। ভাঙ্গা মেশিনের মতো বাংলাদেশ মেরামতযজ্ঞে তিনি হাত দিলেন। হাত দিয়েই তিনি আঁচ করলেন চোর, লুটেরা আর দুর্নীতিবাজে ভরা দেশমাতৃকা ভালো নেই; বাঙ্গালী জাতির জন্য তাঁর দু’হাত পেতে ভিক্ষে করে আনা সাহায্যে তিলে তিলে গড়ে তোলা দেশের সম্পদ পাচারে ব্যস্ত জনগণের সেবক নামধারীরা!

যিনি নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আপোস করেননি সমগ্র বাঙ্গালি জাতির অস্তিত্বের সাথে, তিনিই তো শেখ মুজিব। কি করে সইবেন তিনি তাঁর দেশের অকৃতজ্ঞ সভ্যসমাজের এহেন দেশবিরোধী কর্মকান্ড? তাইতো তিনি কঠোর হলেন সময়ের প্রয়োজনে। বাঘের হুংকার ছেড়ে হুশিয়ার করলেন উচ্চাভিলাষী আর ক্ষমতালিপ্সুদের, যারা নিজ প্রয়োজনে দেশকে বিকোতে দু’বার ভাবেন না। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই তার ভাষণে বলতেন, ‘এই স্বাধীনতা, এই মুক্তি অর্থহীন, যদি না মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসে।’

বঙ্গবন্ধুর এই বিশ্বাসে তারাই কুঠারাঘাত করলো। নির্দশ মানা তো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন যেন বাস্তবায়ন কোনদিন না হয় সে চেষ্টাই করলো। তবুও ঠেকানো গেলো না কারণ দয়াদ্র এ মহাত্নার আহ্বান তখনো দেশপ্রেমিক কৃষক, দিনমজুর,কুলি,তাঁতি, শিক্ষক আর ছাত্রদের কাছে অমোঘ বিধান। যড়যন্ত্রকারীরা শেষে শুরু করলো আমলাতান্ত্রীক লুটতরাজ। জাতির জনকের এক একটি স্বপ্নের রুপরেখা বন্দী হয়ে গেলো পঙ্গু বাংলাদেশের কফিনে। নিয়মে নিয়মে পরিকল্পনা ভেস্তে, কলহ-বিবাদে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আর আমলাদের ব্যক্তিস্বার্থে ধীরে ধীরে কোণঠাসা হতে থাকলেন আমাদের জাতির জনক। ষড়যন্ত্রের মাকড়াসা জাল বুনে দিলো সোনার বাংলার স্বপ্নবর্তিকায়। তারপর একদিন ঘাতকদের হানায় অস্তমিত হলো মুক্তির সূর্য। পরের ঘটনা সবার জানা।

বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসতে বড়জোর আর বছর দশেক লাগতো যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন।

৭৫’এর ১৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপটের সাথে ২০১৮ সালের প্রেক্ষাপটের মিল পাই। ষড়যন্ত্রকারীরা তখন যেভাবে জাতির জনকের পাশে ছিলো শুভাকাঙ্খার আবরণে, তেমনি আজও এই রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে ঘিরে রয়েছে নামধারী বঙ্গবন্ধু প্রেমিক অক্টোপাসেরা।
এই মহান নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে আদায় করছে রাষ্ট্রের সর্বৈব সুবিধা। অথচ ঘাপটি মেরে তারা সুযোগের অপেক্ষায়। সময় পাল্টালেই বসিয়ে দেবে মরণকামড়।

এরাই আজ শোককে ‘স্মরণের দিন’ থেকে ‘উৎসব’র দিনে নিয়ে গেছে পরম মমতামাখা ষড়যন্ত্রে। বঙ্গবন্ধু চাইতেন কাজ আর তারা করেন এখন আনুষ্ঠানিকতা; তাও আবার বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমি কখনো আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মনে করিনা। তিনি জাতির জনক। আর জাতির জনকের কোন দল হয়না। মত-পথ-দলের উধ্বে তিনি। তবে কষ্ট হয়, এদেশে এখন বঙ্গবন্ধুর কথা বললে মানুষ ভাবে আওয়ামী লীগ করি আর না বললে ভাবে স্বাধীনতার পক্ষের নই। তবে বাঙ্গালী জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করতে কারো মানা না মানার অপেক্ষা করবো না কখনো। অন্য কোন যুক্তি বুঝতে চাইনা, তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলেই স্বাধীন দেশে বাস করি, এজন্য তার কাছে আমৃত্যু কৃতজ্ঞতা।বুকএই বাংলা এখনও সোনার বাংলা হয়নি। এখনো লুটেরাদের রাজ্যপাট তুঙ্গে। সরকার এসব লুটেরাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, যে লুটেরাদের সঙ্গে জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুই আপোস করেননি। এভাবে দেশ চলতে পারে না। এই দিনেই অকৃতজ্ঞ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধুর ঋণ শোধ করেছে তাঁর বুক বুলেটবিদ্ধ করে। তাই দিনটা যতটা শোকের, ততটা লজ্জার। শোক আর লজ্জা ছাপিয়ে ১৫ই আগস্টে আজ উৎসবের মেজাজ সর্বত্র। হাজার গরু-খাসি কাটা হচ্ছে, খানাপিনা হচ্ছে।

এমনটা চেয়ে দেশ স্বাধীন করেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই হাত চেয়েছিলেন, যে হাত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ব্যবহার হবে আবার আর্তের অশ্রুও মুছে দেবে।

চিরঞ্জিব হউন বঙ্গবন্ধু ইতিহাস থেকে ইতিহাসে, যুগ থেকে যুগান্তরে। শ্রদ্ধা!

লেখকঃ
নাইমুর রহমান
সম্পাদক,
জাগো নাটোর ২৪ ডটকম ও
জেলা প্রতিনিধি, দি এশিয়ান এইজ।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *