নাটোর অফিস॥
ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৯টা। নাটোরের মাধনগর রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মে প্রসব বেদনায় ছটফট করছিলো সোনিয়া খাতুন(২০) নামে এক নারী। অসহ্য যন্ত্রনায় চিৎকার দিয়ে উঠলেও তার কাছে এগিয়ে যায়নি স্টেশন প্লাটফর্মে অবস্থানরত নারী পুরুষদের কেউ। তাদের কউ কেউ দুর থেকে তাকিয়ে দেখেছিলেন । আবার কেউ কেউ কাছে গেলেও সোনিয়ার যন্ত্রনা আর সুস্থ্যতা নিয়ে ভাবেনি। মানসিক প্রতিবন্ধী বা পাগল ভেবে কেউ তার কাছে যেতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু রাত যখন গড়িয়ে ১০ টার কাছাকাছি, ঠিক সেই সময় তার যন্ত্রণার মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে প্রসব বেদনায় চিৎকার আর কান্নাকাটির আওয়াজে চারিপাশের পরিবেশ যেন ভাড়ি হয়ে ওঠে। এমন সময় এগিয়ে আসেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা আতাউর রহমান ও তার লোকজন। সোনিয়ার অবস্থার অবনতি দেখে তাৎক্ষনিক ভাবে তাকে উদ্ধার করে নলডাঙ্গা বাজারে বেসরকারী বিসমিল্লাহ হাসপাতাল নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেন। সেখানে নিবির পর্যবেক্ষনে রেখে চিকিৎসার দেয়ার পর অবশেষে রাত সাড়ে ১১ টার দিকে স্বাভাবিক ভাবে তার একটি সন্তান ভুমিষ্ট হয়। সোনিয়ার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান। বর্তমানে ওই হাসপাতালে মা ও ছেলে দুইজনই সুস্থ্য আছে। বিসমিল্লাহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিবির পরিচর্যা আর আতাউর রহমানের মহানুভবতার কারনে সোনিয়া অনায়াসে পেলো তার প্রেয়োজনীয় চিকিৎসা আর সুস্থ্য সন্তান। এতে সোনিয়া বেশ খুশি। তবে এবার সন্তানের বাবার পরিচয় পেতে চান সোনিয়া। অথচ গত এক বছর ধরে তার স্বামীর সন্ধানে বহু স্থান ঘুড়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান মিলেনী। বাস স্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশনসহ পথে ঘাটে স্বামীর সন্ধানে গর্ভবতী অবস্থায় ছুটে বেড়িয়েছে। সোনানিয়া খাতুন জানান, তার জন্মস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর গ্রামে। বাবার নাম মঞ্জু, দুই ভাই রিমন ও শিমুল এবং তার এক সৎ মা রয়েছে। সেখানেই তারা বসবাস করেন। পরিচয়হীন ছেলেকে বিয়ে করার কারনে পরিবারের লোকজন তাকে দেখতে পারে না। তাই সেখানে যেতেও পারে সোনিয়া।
সোনিয়া বলেন, বাবার দারিদ্রতার কারনে ছোট বেলায় তার লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। তার ওপর মা মারা যাওয়ার পর সৎ মায়ের কারনে বাড়িতে ঠিকমত ভাতও জুটতো না। অবশেষে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেয় সোনিয়া। বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন রুটে ট্রেনের মধ্যে ঘোরা ফেরা আর ভিক্ষা করেই চলছিল তার জীবন-জীবিকা। এরইমধ্যে ট্রেনের ভিতর কোন একদিন অচেনা এক ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়। এরপর গত প্রায় তিন বছর আগে সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশনে তাদের বিয়ে হয় ওই ছেলেটির সাথে এবং সেখানেই তাদের সংসার চলে। কিন্তু কোথায় তার স্বামীর বাড়ি, কি তার পরিচয় সেবিষয়ে কিছুই জানা হয়নি সোনিয়ার। আর সরলতার সুযোগ নিয়ে লম্পট স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। পরে আর তার সাথে দেখাও হয়নি। এরই মধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়ে সোনিয়া। এ অবস্থায় তার স্বামীকে প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় পাবে তার স্বামীকে ? তার তো কোন ঠিকানাই জানা নেই তার। শেষ পর্যন্ত গর্ভবতী অবস্থায় গত এক বছর ধরে নাটোরের আব্দুলপুর রেলস্টেশনে বসবাস আর বিভিন্ন জনের কাছে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এরইমধ্যে তার পেটে সন্তান হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেড়ে উঠেছে এবং প্রসবের সময়ও ঘনিয়ে আসছিল। এ অবস্থায় স্থানীয় এক পরিচিতজনের পরামর্শে স্বামীকে খুঁজে বের করার জন্য বৃহস্পতিবার (০১ এপ্রিল) বিকেলে আলী হায়দার নামে এক ভ্যান চালককে সাথে নিয়ে উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেনযোগে সান্তাহারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সোনিয়া। পথে ট্রেনের ভিতর তার প্রসব বেদনা শুরু হয়। পরে নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনগর রেল স্টেশনে নেমে পড়ে এবং প্রসব বেদনায় কাতরাতে থাকে। এক পর্যায়ে রাতে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় নলডাঙ্গা বাজারের বিসমিল্লাহ হাসপাতালে তার ঠাঁই মিলে। সেখানেই তার বাচ্চা প্রসব হয়। সোনিয়া বলেন, এখন তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বাবার বাড়িতেও সেরকম পরিবেশ নেই। এখন সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন সেই চিন্তা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বিসমিল্লাহ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ ওয়ারেছুন নাহার জেসি জানান, মা ও সন্তান দুইজনই সুস্থ্য আছেন। তবে বাচ্চাটি মায়ের বুকের দুধ একটু কম পাচ্ছে। তাই বাহির থেকে দুধ কিনে শিশুর ক্ষুধা নিবারন করা সহ তাদের পরিচর্যা চলছে। বিসমিল্লাহ হাসপাতালের মালিক মোঃ আনোয়ার হোসেন জানান, মানবিক কারনে গত রাতে সোনিয়া নামে ওই মেয়েটিকে তার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদানসহ ওষুধ, বাচ্চার দুধ ও খাওয়া-দাওয়া এবং সকল প্রকার সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। তবে মাধনগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মোঃ আতাউর রহমানও এব্যাপারে সহযোগিতা প্রদান করছেন। তিনি বলেন,দুই একদিনের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। তবে তার বাড়ি চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর গ্রামে বলে সোনিয়া তাকে জানিয়েছে। এজন্য তার অভিভাবকদেরও সন্ধান করা হচ্ছে।
মাধনগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মোঃ আতাউর রহমান বলেন, মানবিক কারনে ওই মেয়েকে প্রসব বেদনা অবস্থায় বিসমিল্লাহ হাসপাতালে ভর্তি করাসহ বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হয়। মেয়েটি যাতে তার ভুমিষ্ঠ শিশুটিকে নিয়ে অভিভাবকদের কাছে পৌছাতে পারে, সেবিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তিনি দাবী করেন।
নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বিষয়টি অত্যান্ত মানবিক। মেয়েটি যাতে তার শিশু সন্তানকে নিয়ে অভিভাবকের কাছে ফিরে যেতে পারে এবং তার যাতে ভাল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, সে ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা হবে। যারা মানবিক কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন, তাদের ধন্যবাদ জানান তিনি।